শামীমুল ইসলাম শামীম, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার ১১নং বগুড়া ইউনিয়নের কামান্না গ্রামে ও ১১নং আবাইপুর ইউনিয়নের আবাইপুর গ্রামে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে ১৯৭১ সালে এই দুটি গ্রামে ৪৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।
পরে তাদের সমাধিস্থ করেন গ্রামবাসীরা। এই দুটি স্থান দীর্ঘদিন অযতœ আর অবহেলায় পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয়দের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অবশেষে এই দুটি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর শহিদদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে খুশি স্থানীয় বাসিন্দা ও মুক্তিযোদ্ধারা।
ঝিনাইদহ গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ফারুক হোসেন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার কামান্না ও আবাইপুরে দুটি স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগ এই কাজ বাস্তবায়ন করেছে। কামান্নায় প্রায় ১০ শতাংশ জমির ওপর ৭১ লাখ ১৮ হাজার ৪১৪ টাকা ব্যয়ে এবং আবাইপুরে প্রায় ১২ শতাংশ জমির ওপর ৭১ লাখ ৯৮ হাজার ২৫০ টাকা ব্যয়ে স্মৃতিস্তম্ভ দুটি নির্মাণ করা হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, শৈলকুপা উপজেলার ১০নং বগুড়া ইউনিয়নের কামান্না এবং ১১নং আবাইপুর ইউনিয়নের আবাইপুর গ্রামে নির্মিত হয়েছে বিশাল আকৃতির দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। একটি কামান্না মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশে। সেখানে ঘুমিয়ে আছেন ২৮ জন বীর শহিদ।
এ ছাড়া আবাইপুর বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সামনে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আবাইপুরে ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ পেয়ে এই স্থানে গণকবর দিয়েছিলেন স্থানীয়রা। কামান্না ও আবাইপুরে নির্মিত বিশাল দুটি স্মৃতিস্তম্ভে লেখা হয়েছে বীর শহিদদের নাম। এর ঠিক পেছনেই রয়েছে স্মৃতিসৌধ।
কামান্না গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আলী বিশ্বাস ও সিরাজুল ইসলাম সিরাজ কাজী জানান, ১৯৭১ সালে কামান্নায় কোনো সম্মুখ যুদ্ধ হয়নি। স্থানীয় রাজাকারদের ষড়যন্ত্রে এখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন দিতে হয়েছে। মাগুরার শ্রীপুর দখলমুক্ত করে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা এসে পৌঁছান কামান্নায়। দলের নেতৃত্বে ছিলেন দুই তরুণ আবু বকর ও আলমগীর হোসেন। দীর্ঘপথ পাঁয়ে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে সবাই আশ্রয় নেন গ্রামের মাধব চন্দ্র ভৌমিক ও ছামেলা বেগমের বাড়িতে। ক্লান্তিতে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েন।
রাতে স্থানীয় রাজাকাররা এই খবর পাঠিয়ে দেয় ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অস্থায়ী আর্মি ক্যাম্পে ও মাগুরা সদরের অস্থায়ী পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে। দুই পাশ থেকে রাতের আঁধারে কামান্নার দিকে এগিয়ে আসে পাকিস্তানি হানাদাররা। তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে রাজাকাররা। ঘটে যায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে হানাদাররা মাধব ভৌমিকের টিনের ঘর লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে।
টিনের বেড়া ভেদ করে ছুটে আসতে থাকে গুলি। এ সময় কেউ ঘরের মধ্যে আবার কেউ বাইরে উঠানে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়েন। পাশেই বৃদ্ধা ছামেলা বেগমের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও গুলি করে হত্যা করা হয়।
সকালে চারদিকে দুঃসবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ এক জায়গায় করেন স্থানীয়রা। এরপর ঘটনাস্থলের পাশেই মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করা হয়। সেখানেই দীর্ঘ ৫২ বছর পর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।
মীনগ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মিলন বিশ্বাস ও আবাইপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ সবদুল মিয়া জানান, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর মাগুরার শ্রীপুর খামারপাড়া বাজারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শৈলকুপার দিকে আসতে থাকে হানাদার বাহিনী। খবর পেয়ে প্রতিহত করার সিদ্ধান্তদ নেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা বাঙ্কার খুঁড়ে অবস্থান নেন।
পাকিস্তনি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের কাছে সেই খবর পেয়ে যায়। ১৪ অক্টোবর ভোররাতে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা পেছন দিক থেকে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। আধাঘণ্টা চলে সেই যুদ্ধ। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
সকালে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা চলে গেলে ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ সমাহিত করা হয়। যে স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর দেওয়া হয়েছিল সেই স্থান দীর্ঘ ৫২ বছর অবহেলিত ছিল।
কবরগুলো আড়াল হয়ে গিয়েছিল জঙ্গল আর ঝোপঝাড়ে। নতুন প্রজন্ম ভুলতেই বসেছিল রক্তাক্ত সেই ইতিহাস।
[…] […]