সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৫:১৯ অপরাহ্ন
জরুরী ঘোষণা :
নতুন সকাল ডটকম পড়ুন ও বিজ্ঞাপন দিন। নতুন সকাল ডটকম পড়ুন ও বিজ্ঞাপন দিন নতুন সকাল ডটকম পড়ুন ও বিজ্ঞাপন দিন নতুন সকাল ডটকম পড়ুন ও বিজ্ঞাপন দিন *
সংবাদ শিরোনাম

কারাগারের করোতলে ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা

  • আপডেট : শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ১০.৪৩ পিএম
  • ৬১৪ জন পড়েছেন
কারাগারের করোতলে ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০২১ সালের জুলাই মাসে খুলনা কারাগারের কারোতলে রোগী দেখছিলাম। হঠাৎ বাইরে হট্টগোলের আওয়াজ। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার কে দেখতে বললাম। বললেন, ‘ম্যাডাম, পাগল খুনিটা আবার খেপেছে ‘। বললাম ,’রোগীকে এভাবে এড্রেস করবেন না…’ কথা শেষ হবার আগেই প্রায় দরজা ভেঙে ,অন্যান্য রোগীদের ঠেলে , পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আমার সামনে ছয় ফিট লম্বা সুঠাম দেহী উস্কোখুস্কো চুল ময়লা দেহাবরণের এক দন্ডায়মান মূর্তি আবির্ভূত হলো।
পুলিশ হাতের মোটা লাঠিটা উঠাতে যাবে, আমি নিষেধ করলাম। প্রচন্ড উত্তেজিত সেই রোগীকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ এমন করছেন কেন?’
স্পষ্ট জড়তাহীনভাষায় বললেন,’বিশ্বাস করেন ম্যাডাম আমার বোন সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমাকে ছেড়ে দিন। ওরা আমার বোনকে মেরে ফেলবে।’
তার আর আমার মধ্যে দশ হাত দূরত্ব। একটা লম্বা ফিতা দিয়ে সীমারেখা তৈরি করা আছে। সীমারেখার দুপাশে দন্ডায়মান অস্ত্রধারী পুলিশ কনস্টেবল।
জেলখানায় রোগী দেখতে এসে এমন ১/২জন অপ্রকৃতস্থ রোগীর দেখা পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
ফার্মাসিস্ট ছিলেন পাশে। বললেন ‘ম্যাডাম ,উনার বোন সরকারি কর্মচারী ছিলেন। বিনা কারণে অফিশিয়াল ষড়যন্ত্রে ফাঁসানোর জন্য তার নামে বেনামি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির ভাষা যতটা জঘন্য ছিল, তার চেয়ে বেশী জঘন্য ছিল আশেপাশে মানুষের দৃষ্টি। বোনটি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। উনি দীর্ঘ দিন ফোর্সে ছিলেন। ছোট বোনের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি। চাকরি ছেড়ে দিন রাত এখানে এসে খুঁজে বেড়িয়েছেন অপরাধীদের ‌। নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছেন সেই বেনামীচিঠির লেখক ও ষড়যন্ত্রকারীদের। প্রত্যেককে মেরে তাদের সারাগায়ে রক্ত কলমে লিখে দিয়েছেন বেনামি চিঠি।
সেই গা ভর্তি চিঠি লেখা লাশ দেখে যে কেউ শিউরে উঠবে।
একদম পাক্কা সাইকো সিরিয়াল কিলার।’
‘তাকে মেন্টাল এসাইলাম এ কেনো পাঠাচ্ছেন না?’
‘ম্যাডাম উনি বছরের বেশিরভাগ সময় সুস্থ থাকেন স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন । হঠাৎ করেই পাগলামী করেন। এখন সত্যি সত্যি পাগল না পাগল সেজে থাকে তাই আসলে উনার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আর আজ বাদে কাল তো ফাঁসি হবেই।’
দীর্ঘনিঃশ্বাসটা আটকাতে পারলাম না।
একজন ফাঁসির আসামি তার মৃত বোনকে বাঁচানোর জন্য পাগলামির নাটক করবেন বিশ্বাস হলো না।
অনেকেই পাগলের নাটক করে এখানকার কঠিন জীবন থেকে অব্যাহতি পেতে চায়, এতে যারা সত্যিই অসুস্থ তারা প্রকৃত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রতিদিন এখানে এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়।
আমার নানা পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, তাই জেলখানা ,অপরাধী আমার কাছে খুব অপরিচিত শব্দ নয়। তবুও কেন যেন জেলখানার বিশাল লোহার দরজা পেরিয়ে, মোবাইলফোন চেকিং এ জমা দিয়ে , সকল প্রকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ২/৩ জন পুলিশ সহ যখন এখানে প্রবেশ করি মনে হয় বহির্বিশ্ব থেকে যোজন যোজন দূরবর্তী এক সম্পূর্ণ আলাদা জগতে প্রবেশ করেছি।
যাদের চিকিৎসা দিচ্ছি তারা কেবল অসুস্থ নয়,অপরাধীও বটে। বৃহৎ অর্থে কেবল অপরাধী নয়, মানুষও বটে।
এতগুলো দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী একই জায়গায় মিলেমিশে অবস্থান করছে। কেউ খুনি, কেউ চোর, কেউ ডাকাত, কেউবা ধর্ষণ মামলার আসামি। কেউ হয়তো ১০ বছর জেল খাটছে, কেউ হয়তো ফাঁসির আসামি ,কেউ হয়তো আর দুমাস পরে চলে যাবে।জেলখানায় যত বছর জেলে হয় সেই বছরের হিসাব টা আমাদের বছরের হিসাব থেকে আলাদা। মহিলাদের জন্য আলাদা পার্টিশন। সেখানে অনেক আসামীর কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশু দেখে মনে একটা কথাই উদয় হয় মা মানে মা, মা বাদে মায়ের কোন আর কোনো বড় পরিচয় নেই।
শান্ত এক গৃহবধূ থেকে যৌতুকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শাশুড়িকে শিলপাটার লোহার নোরা দিয়ে মাথায় আঘাত করে খুনি হওয়া আসামীও মা।
সবথেকে কমন রোগ কারোরই রাতে ঘুম হয় না। সকলে ঘুমের ওষুধ চায়। যেন ঘুমিয়ে থাকাই সবকিছুর চিকিৎসা।
মেয়েদের কলোনি পাড়ার কলোনির মত। মাঝে মাঝেই চুলোচুলি হয়। মহিলা পুলিশ সার্বক্ষণিক থাকে।
এক একটি কলোনীর এক একটি নাম ।
কোনোটা কপোতাক্ষ কোনোটা শিবসা। কলোনির মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট উঠান। সেখানে অবসরে তারা রোদ পোহায়। একে অন্যকে তাদের জীবনের কাহিনী শোনায়।
এরা যে ঘরগুলোতে বসবাস করে, তার দেয়ালে বড় বড় করে লেখা থাকে ‘পাপকে ঘৃণা করো পাপীকে নয়’। আরবিতে বড় করে লেখা ‘ইস্তেগফার’। লাল কালিতে লেখা আছে, ‘দন্ডিতের সাথে যবে দন্ডদাতা কাঁদে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার’।
‘১০ জন দোষী ছাড়া পাক,কিন্তু একজন নির্দোষ যেন কোনোভাবেই শাস্তি না পায়।’
এই লেখাগুলো তাদেরকে প্রভাবিত করে কি, জানিনা!!
তবে জেলখানায় তারা খুব সুশৃংখল জীবন যাপন করে। রুটিন মাফিক জীবন যাপন ।খাওয়া-দাওয়া,ঘুমানো, গাছ লাগানো ,শারীরিক পরিশ্রম করা। অনেকে শখের জিনিস বানায়, গান গায় ,ছবি আঁকে। অনেকে চিঠি লেখে।
অনেকেই হয়তো পুরোপুরি নির্দোষ , প্রমাণের অভাবে , অর্থের অভাবে ,ভালো উকিল ধরতে না পারার অভাবে সমান্তরাল কালো লোহার শিকগুলোকে তারা তাদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে।
আমি যখন তাদের চিকিৎসা দিয়ে বের হয়ে আসি তখন তাদের দুপুরের খাবারের সময়। আমাকে এখানে কমবেশি সব আসামিরাই চিনে ফেলেছে। গতদিন ফেরার পথে একজন দাঁড়িয়ে হাত তুলে সালাম দিয়ে বললেন, স্যার বালতি ভরে ডাল নিয়ে যাচ্ছি আমাদের সাথে দুটো ডাল ভাত খাবেন নাকি?
এমন আন্তরিক খাবারের ডাক অনেক সুস্থ মানুষের মধ্যেও পাওয়া যায় না।
মাঝে মাঝে ওদের সাথে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছা করে ঠিক কোন টার্নিং পয়েন্টে একটা মানুষ অপরাধী হয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই অনেক অনেক বার বিবেকের তাড়নায় থেমে গেছে। নিশ্চয়ই ভীষণ হাত কেঁপেছিল। ছুরি চালানোর সময় হৃৎস্পন্দন হয়তো কিছুক্ষণের জন্য তারও থেমে গিয়েছিল।
অপরাধীদের সাইকোলজি/ ক্রিমিনোলজি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু তার ইমপ্লিমেন্ট আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এবং সমাজ ব্যবস্থায় খুবই কম।
আমার জীবনে অপরাধীদের প্রতি এই ফ্যাসিনেশন এর জনক ব্যোমকেশ, ফেলুদা ,শার্লক হোমস যথাক্রমে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ,সত্যজিৎ রায় এবং আর্থার কোনান ডয়েল। গোয়েন্দা কাহিনীর বইয়ের মধ্যে সত্যান্বেষণে বহুবার দেখেছি অপরাধের শাস্তি কেবলমাত্র আইন বিচার দিয়েই হয় না। অপরাধী মনস্তত্ত্বকে বদলাতে হয়। না হলে আসামী মুক্ত হয়ে আবারও অপরাধ করবে। আর অপরাধীর মনস্তত্ত্বের সাথে একাত্ম হওয়া খুব সহজ বিষয়ও না। সেজন্য অপরাধীর মত করে ভাবতে হয় ,অপরাধী কোন সিচুয়েশনে অপরাধে জড়ালো সেই সময়টি সাথে একাত্ম হতে হয়।
এরা নাহয় উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করে চলেছে দিন রাত।
যারা বাইরে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মধ্যে কি অপরাধী নেই??
এমন অনেক সাইকো প্যাটার্নের, ভালোভাবে বললে মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জড মানুষ এই পৃথিবীতে রয়েছে যাদের সাইকোলজির এই মতিভ্রম অন্যকে বুঝাতে গেলে আপনি গলদঘর্ম হয়ে যাবেন। কেননা সমাজে অত্যন্ত মিষ্টভাষী মুখোশ পরে সকলের মধ্যে মিশে থাকে।
আফসোস,কোন আইনে তাদের ফেলা যায় না বলে তাদের একটা জেলখানা নেই।
সেক্সপিয়ারের হ্যামলেট এ আমার খুব প্রিয় একটি লাইন
There is nothing either Good Or Bad
But Thinking Makes it so ..
পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ ভালো বা মন্দ বলে কিছু নেই
আমাদের চিন্তাই ভালো বা মন্দ তৈরি করে।
ক্রিমিনাল সাইকলজি থেকে শিক্ষা ,আমরা যেন সেইসব অপরাধ না করি, অপরাধী যে মুহুর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ওই মুহূর্তে আমি যেন আর দিকভ্রষ্ট না হই, এবং নিজেও যেন কাজ বা কথার আঘাতে কোনভাবে অন্য এক অপরাধীর জন্ম না দেই। আরো একটি বাণী -অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে দুজনেই অপরাধী।
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য কথা এই যে,আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে রোজই তৈরি হচ্ছে কোন না কোন অপরাধী। হঠাৎ করেই জন্ম হয় না।
কোন এক ভয়াবহ টার্নিং পয়েন্ট থেকে শুরু হয়
স্বাভাবিক থেকে এক অপরাধী জীবনযাত্রার সূচনা।
সেই টার্নিং পয়েন্টে আপনি ,আমি কেউ নই তো??
ভালো করতে না পারি, কারোর এতো টুকু
ক্ষতি যেন না করি।
পৃথিবীই যে এক বিরাট জেলখানা।
এই নিদারুণ উপলব্ধি কেন হয় না আমাদের!!

নিউজটি শেয়ার করুন

নিচে আপনার মতামত লিখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published.

ThemesBazar-Jowfhowo
# নতুন সকাল ডটকম, খুলনা রূপসা থেকে প্রকাশিত একটি অনলাইন পত্রিকা। # এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া কপি রাইট বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।