তরুণ চক্রবর্তী বিষ্ণু : রূপসী রূপসায় প্রবাহমান নদীর তীরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে বাঙালি জাতির দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের একজন বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও আরেকজন বীর বিক্রম মো. মহিবুল্লাহ। যাদের জীবন আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছি আমরা লাল সবুজের পতাকা।
সালটা ১৯৭১। ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে যশোর সেনানিবাসের পতন ঘটে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত খুলনাস্থ নৌঁঘাটী দখল করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারতীয় গানবোট পাভেলের সাথে ‘পলাশ’ ও ‘পদ্মা’ যুক্ত হয়ে ১০ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। গানবোট ‘পাভেল, পলাশ ও পদ্মা’ মোংলা বন্দর হয়ে খুলনার দিকে রওনা দেয়। গানবোট ‘পাভেল’ সামনে আর পেছনে ‘পলাশ’ ও ‘পদ্মা’।
গানবোট পলাশে ছিলেন ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার রুহুল আমিন আর পদ্মায় কামানের ক্রুম্যান মো. মহিবুল্লাহ। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২টার দিকে গানবোটগুলো খুলনার শিপইয়ার্ডের অদূরে পৌঁছালে ভুল সিগনালের কারণে মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের নিক্ষিপ্ত বোমায় পলাশ জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথম গোলা এসে পড়ে ‘পদ্মা’য় এবং পরবর্তীতে ‘পলাশে’। গোলা সরাসরি ‘পদ্মা’র ইঞ্জিনরুমে আঘাত করলে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত হয়। হতাহত হয় অনেক নাবিক। ‘পদ্মা’র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুঁড়তে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী রুহুল আমিন তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যান ‘পলাশ’কে বাঁচানোর। তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে আগুন ধরে যায় এবং গোলার আঘাতে রুহুল আমিনের ডান হাতটি সম্পূর্ণ উড়ে যায়। অবশেষে পলাশের ধ্বংসাবশেষ পিছে ফেলেই আহত রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ যোদ্ধা একসময় পাড়েও এসে পৌঁছান। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে রাজাকারের দল অপেক্ষা করছে তার জন্য। আহত এই বীর সন্তান রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। তার মৃতদেহ বেশকিছুদিন সেখানে পড়ে ছিলো অযতেœ, অবহেলায়। পরবর্তীতে স্থানীয় জনসাধারণ রূপসা নদীর পাড়ে তাকে দাফন করে। বোমার আঘাতে দুই গানবোটেই আগুন ধরে যায়। দু’টিতে ৫৬ জন নৌযোদ্ধা ছিলেন। বিপদ আন্দাজ করে কেউ কেউ আগেই পানিতে ঝাঁপ দেন। তারা বেশির ভাগ অক্ষত থাকেন। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মো. মহিবুল্লাহসহ যাঁরা রণতরিতে ছিলেন তারা শহীদ হন, নয়তো মারাত্মকভাবে আহত হন। মো. মহিবুল্লাহ বিমানের প্রথম আক্রমণেই শহীদ হন। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা সাঁতরে নদীর পাড়ে এলে অনেককে পাকিস্তানি সেনারা বা তাদের সহযোগী রাজাকাররা আটক করে। কয়েকজনকে তারা সঙ্গে সঙ্গে হত্যা এবং বাকিদের নির্যাতনের পর জেলে পাঠায়। ১৮ ডিসেম্বর নৌ-মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংসপ্রাপ্ত গানবোট থেকে দুটি মরদেহ উদ্ধার করেন। এর মধ্যে একটি ছিল শহীদ মো. মহিবুল্লাহ’র। আটদিনে তার মরদেহ শুকিয়ে হাড়ের সঙ্গে কেবল চামড়া লেগেছিল। তারপরও সহযোদ্ধাদের তার মরদেহ চিনতে কষ্ট হয়নি। সহযোদ্ধারা পরে তাদের মরদেহ রূপসা নদীর পূর্ব তীরে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধির পাশে সমাহিত করেন।
১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর সরকারি গেজেট নোটিফিকেশন অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাতজন বীর সন্তানকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। রুহুল আমিন সেই সাতজনের অন্যতম। অপরদিকে মো. মহিবুল্লাহকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় অযতেœ ও অবহেলায় পড়ে থাকে কবর/সমাধিস্থল। চারপাশে ময়লা আর নোংরা আর্বজনায় পরিপূর্ণ। স্হানীয় অনেকেই জানতো না এটা দুই শহীদ বীরের সমাধি। শুধুমাএ বছরে একটা দিন নৌবাহিনী ফুল দিয়ে যেত।
সালটা ১৯৯৭ প্রভাবশালী কিছু মানুষের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে সমাধি সংলগ্ন ঐ জায়গার উপর। তখন সমাধিস্থল রক্ষায় রূপসা প্রেসক্লাবের বর্তমান উপদেষ্টা মো. সামছুজ্জামান শাহীনের অনুপ্রেরণায় বর্তমান সভাপতি এস এম মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রেসক্লাবের উপদেষ্টা মো. আনোয়ার হোসেন, সাবেক সভাপতি তরুণ চক্রবর্তী বিষ্ণু, রবিউল ইসলাম তোতা ও সাইফুল ইসলাম বাবলু কাজ শুরু করেন। আর মহতী এ কাজটিকে বাস্তবায়নে মূল সহায়তা করেন তৎকালীন বিবিসি’র খুলনা প্রতিনিধি ও দৈনিক সংবাদের খুলনার প্রধান প্রথিতযশা সাংবাদিক প্রয়াত মানিক চন্দ্র সাহা। শুরু হয় সমাধিস্থল রক্ষায় বিভিন্ন মিডিয়ায় লেখালেখিসহ আলোচনা সভা। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় সচিত্র প্রতিবেদন। এ সময় আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন তৎকালীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর নজরুল ইসলাম, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কর্ণেল আব্দুস সালাম (বীর প্রতীক), খুলনার পুলিশ সুপার মো. আওলাদ হোসেন মিয়া। তৎকালীন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর নজরুল ইসলাম সীমানা প্রাচীরসহ মাজার কমপ্লেক্স ডিজাইন করেন তার আর্কিটেক্ট বিভাগের মাধ্যমে। আর খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কর্ণেল আব্দুস সালাম (বীর প্রতীক) প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ দেন স্থানটিকে মাজার কমপেলক্স বা স্মৃতিসৌধ নির্মাণে। এভাবে শুরু হয় বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও বীর বিক্রম মহিবুল্লাহর সমাধিস্থল।
সেই ১৯৯৭ সাল থেকে রূপসা প্রেসক্লাব বাংলার দুই সূর্য্য সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও বীর বিক্রম মহিবুল্লাহার স্মৃতি রক্ষায় প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্টসহ তাদের বীরত্বগাথা নিয়ে আলোচনা স্মরণ সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যাচ্ছে অদ্যাবধি। এই ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্টে জাতীয় দলের অনেক খেলোয়াড় অংশ গ্রহণ করে আসছে।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও বীর বিক্রম মহিবুল্লাহ’র সমাধিস্থল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং নতুন করে সমাধিস্থলের সীমানা প্রাচীর, প্রধান ফটক, মাজার কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম করে। তাছাড়া রূপসা উপজেলা প্রশাসন তদস্থল দেখভালের জন্য কেয়ারটেকার নিযুক্ত করে।
প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও বীর বিক্রম মহিবুল্লাহ’র শাহাদাৎ বার্ষিকীতে নৌবাহিনী, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, রূপসা প্রেসক্লাব, মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তাছাড়া ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ রহুল আমিন ও বীর বিক্রম মহিবুল্লাহ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন আমাদের লাল সবুজের পতাকার জন্য। তাদের আত্মত্যাগে পেয়েছি আমরা স্বাধীন ভূখন্ড।
Leave a Reply